20 February,  2016   Editor: Dipankar Dutta   Email: deepankar_dutta@yahoo.co.in   * Mob: 9891628652  *  New Delhi

Those that much covet are with gain so fond, For what they have not, that which they possess They scatter and unloose it from their bond, And so, by hoping more, they have but less; Or, gaining more, the profit of excess Is but to surfeit, and such griefs sustain, That they prove bankrupt in this poor-rich gain.


                                                          এই সংখ্যায়  

কাব্যানালিসিস :     রমিত দে

অনুবাদ কবিতা :     মাণিক সাহাআশরাফ ফায়াধ,    ভাস্বতী গোস্বামী⇨রঞ্জন মৈত্র,
                            দীপঙ্কর দত্ত⇨রমাশংকর যাদব 'বিদ্রোহী', মঙ্গলেশ ডাবরাল 
       

ভিসুয়াল পোয়েট্রি : এলিজাবেথ প্লুটো, ব্রায়্সন ডিন-গথিয়ের

কবিতা :                বারীন ঘোষাল, রবীন্দ্র গুহ, স্বপন রায়, শুভঙ্কর দাশ, সব্যসাচী সান্যাল, ফারহান ইশরাক, ইন্দ্রনীল ঘোষ,
                            অরবিন্দ চক্রবর্তী, ইন্দ্রজিৎ দত্ত,
রিমি দে, উমাপদ কর, অনুপম মুখোপাধ্যায়, পীযূষকান্তি বিশ্বাস,
                            তানিয়া চক্রবর্তী, যাদব দত্ত, অশোক
তাঁতী, দীপঙ্কর দত্ত 

                                                       কাব্যানালিসিস                                                        


                                                      অসমীকৃত স্বদেশ
                                                           রমিত দে

   

                                               “There are times when silence has the loudest voice”-
                                                                                                            Leroy Brownlow


স্বদেশ সেন নেই। আমরা কোথাও দেখতে পাচ্ছিনা তাঁর থাকাকে। আসলে আমরা তাঁর থাকা হয়ে আছি। স্বদেশ আসলে সর্বনামছুট সেই ভুবন যার উত্তরসূরী বা পূর্বসূরী কেউ নেই বরং তিনি নিজেই তাঁর সখা সই স্বদেশ। একধরনের অনুচ্চার নৈঃশব্দের মত স্বদেশ সেন সেই নবীন যাঁর বলার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা আমাদের না-বলাগুলো খুঁজছি আর বারবার ফিরে ফিরে আসছি একধরণের একীভূত একার কাছে। হয় আমরা আমাদেরকে পাচ্ছিনা নয়ত স্বদেশের সমুদ্রে সিদ্ধ হতে। আসলে আশির দশক থেকেই স্বদেশের পরমাণুই হয়েছে নতুন কবিতার আধার পৃথিবী। মন বোধি আর চেতনার মাঝখান দিয়ে একটা সংযোজক রাস্তা রেখে গেছেন স্বদেশ সেন যেখান দিয়ে পৌঁছবার কথা আছে। জীবিত অবস্থায় স্বদেশ যে ছিলেন তারও কিন্তু কোথাও বিশেষ কোনো শব্দ হয়নি কারণ স্বদেশ সেন একটি সংবোধ যিনি ভেতরের আলোকে খুঁজতে চেয়েছেন, আবর্তনকে পার হতে চেয়েছেন। বাংলা কবিতার নতুন ভাষা নিয়ে তাঁর এই অলক্ষিত বেড়ে ওঠা একদিকে যেমন প্রথাগত বাংলা সাহিত্যের শ্রাব্যতা থেকে আলাদা তেমনি সে নীরবতা থেকেও আলাদা। পিটার মিনার্ড যেমন বলেন -Not Merely an absence of noise, Real Silence begins when a reasonable being withdraws from the noise in order to find peace and order in his inner sanctuary- ঠিক তেমনি স্বদেশ সেনও তাঁর নতুন জিভের মত অল্প লাল ভাষা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রথাগত কলা কৈবল্যের বাইরে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কবিতার আর্দশ সম্পূর্ণতার আশ্রয়টিকে, কোলাহলের কুঞ্জবিতান ছেড়ে পৌঁছতে চেষ্টা করেছিলেন নির্বিকল্প কৈবল্যে, দেখার চেষ্টা করেছিলেন তার ভেতরে আরও কত দিক আছে, এই ভেতরেই রয়ে গেছে ভবিষ্যৎ নতুন বাংলা কবিতার প্রস্তুতি। জীবনানন্দ পরবর্তী প্রাতিষ্ঠানিক বাংলা কবিতার মূল্যায়নমুখী বাজারে স্বদেশ সেনই প্রথম হাঁটার সাহস দেখালেন, আভাস থেকে অন্ত অবধি দেখতে দেখতে দেখিয়ে দেওয়ার সাহস দেখালেন। না, কোনো হেরে যাওয়া মানুষ নন, তবে হাতড়ে বেরানো তো বটেই। ওই যে মর্গে পড়ে রয়েছে তাঁর ঠান্ডা নিথর বাংলা কবিতাটি সে তো এখনো চিন্তা করছে, পাশ ফিরলে এখনও যেন বলছে – “ Cogito, ergo Sum- আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি”। তাঁর মৃত্যুর পর কেউ কেউ হয়ত অবিচ্যুয়ারি লিখতে বসেছেন নিশ্চয়, কেউ কেউ জিভ খানিকটা লম্বা করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে অনুকে হয়ত ডাকার চেষ্টা করছেন অনুপম নামে; তবে আমি ঠিক কি চাইছি? খুব বেশি কিছু না। স্রেফ  স্বদেশের ‘দেহ গেহ থেকে বন্ধুত্ব’ অবধি যেতে। স্বদেশের স্বদেশ অবধি। একটু দেখতে স্বদেশের ভিন্নতাগুলো ঠিক কোথায় ! কোথায় তাঁর সেই নবরূপতা যা সাবেকি থেকে নতুনকে দিল সমকালীন উচ্চারণ ; নিজস্ব বলন কৌশলের ধারা থেকে ধারাবাহিক করে তুলল একটা ঘরানার ভাষা।
একজন কবি প্রথমত যেটা বলতে চাইবেন তা তার উপলব্ধি ও কল্পনার পুনর্বাসন। নিয়ম হয়ে দেখা গিয়েছে যে তাকেই অনিয়মের আড়ম্বরে অনুপ্রবেশ চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। স্বদেশ সেনের কবিতার কাছে বসে প্রথম যে কথাটা মনে আসে তা কবির কল্পচেতনা বিষয়ক। ইমাজিন আউট অফ নাথিং ! নাকি ইমাজিন আউট অফ এভরিথিং! পার্থিব এবং অতীন্দ্রিয় –ঠিক কিসে তীব্রভাবে বেঁধে আছে স্বদেশের মূলতন্ত্রীটি!  সিনট্যাক্সের অপরূপে কোনও এক সন্ধ্যায় স্বদেশ হয়ে উঠেছেন আমাদের আত্মীয়, আমাদের সংসারের প্রতিনিধি। আবার কখনও স্বদেশ সেই অপ্রত্যাশিত রহস্য সেই ‘অত শত আকাশে যত হুমানো মেঘ’, যার অন্তরতরঙ্গ যাকে গ্রাস করে আছে, কোনোদিনও কোথাও পৌঁছোতে চাইছেনা যে। শিক্ষার্থী হিসেবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁর কবিতার কাছে হাজির হয়েছি আমরা। তিনি যখন লিখেছেন-“খোকন একটি বাতাবী ফল/ ফিকা রঙের জামা/নেমে যাচ্ছে, মাসকলাইয়ের ক্ষেতে, কেমন একটা ডাক”- তখন আমরা কি স্বদেশের কাছে এসে বসেছি নাকি এই যে বাতাবী ফল, সে আমাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে গেল! সচেতনভাবে ছুটে গিয়ে পলাতক হলাম? সচেতনতা আসলে কি? একটা কগনেটিভ ক্লোজার ছাড়া তার অস্তিত কোথায়? বিপুল প্রস্তুতি সত্ত্বেও দু একটা সঙ্কেত ছাড়া আমরা যে দূরকে পাচ্ছিনা তা কি দুর্ভাবনাকে দাঁড়ের শব্দ দিতে পারছি না বলে? অর্থাৎ আমরা হাত চাপা দিয়ে ঢেকে রেখেছি আমাদের নিজেদেরকে। স্বদেশ সেন লিখেছিলেন- “মাধবীলতাকে আমাদের মাধবীলতা বলতে অনেকেই পারে না।” নতুন ছবির মত স্বদেশ সেন সচেতনভাবে পাঠকের স্নায়ুতে সুরে বিছিয়ে দিয়েছেন অচেতনার আন্তরপঙক্তি। আর তাঁর কবিতার কাছে এসে বারবার কোনো এক অপরিমিত জাগরণভূমির দিকে কান পেতে থাকতে হয়েছে আমাদের।  জীবন স্বপ্ন মাত্র এ কথা বলেননি কখনও স্বদেশ সেন বরং চিন্তা অনুভূতি সংবেদন দিয়ে বর্হিজগতের সত্তাটিকে অন্তঃজগতের সত্তাটির অস্তিত্ব স্বীকার করাতে চেয়েছেন। নতুনভাবে দেখলে নতুন কোণ থেকে দেখলে এই বিপুল রহস্যময় জীবনে একটা ‘ডাক’ একটাই ‘ডাক’ যার ভেতরে যাপনের সার্বিক সংকলন এবং স্বদেশের ক্যানভাসে বড় হতে থেকেছে এই ‘ডাক’ এই প্রতিদিনের পুনর্জন্ম। বাক্যপরম্পরায় স্বদেশ সেন বারবার এনেছেন একধরণের ডায়লজিক প্যারাডক্স। প্রকাশের পরে যা রিসিভার এন্ডে বসে থাকা পাঠকটিকে কেবল একটি কবিতা দেয়না একটি অনুসন্ধানও দেয়। একটা সন্ধিৎসা। অন্বয়। সমঞ্জস্য নির্মাণের একধরনে ক্রাইসিস, যা অর্থনির্ভর শব্দের অধোতলে পড়ে থাকা বোধের চিহ্ন দখলের লড়াই হয়ে ওঠে। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে অনুশীলন করা যাক-

ক) “তুমি হয়ত আমাকে কোনো পাল্কির ভেতর থেকে দেখেছিলে
     তুমি তাহলে সমস্ত পাল্কির থেকেই একবার আমাকে দেখেছো ...”

খ)   “যাদের যা ব্যথা ছিল তাদের কি ব্যথা নেই আর
            সব পথিক কি আজ চোখ মিলিয়ে যাবে
                    শান্ত হবে সব কপালের রগ ...”

গ)        “হাঁপিয়ে ওঠার এই অতি-চিহ্নগুলি দেখো
    জেনো একজন গেছে, খুবই সে হাঁপিয়ে গেছে”

প্রতিটা বাক্যবন্ধে পালা করে করে স্বদেশ রেখে গেছেন আরও একটা বা একাধিক বাক্যকে, বিসারণকে। প্রথাগত ব্যাকরণিক সংবর্তনকে ভেঙে আকস্মিকতার মধ্যে থেকে তুলে এনেছেন নতুন অর্থের দেহ যা কাউকে বলা যায়নি কখনো যা কেউ শোনেনি কখনো। প্রথম বাক্যবন্ধে
তুমি” এবং “পালকি” শব্দের দুবার করে প্রয়োগ ; সেখানে প্রথম বাক্যে দেখার অসম্পূর্ণতা অনিশ্চিতি (তুমি হয়ত) অথচ দ্বিতীয় বাক্যে অদেখার একধরণের সম্পূর্ণতা (তুমি তাহলে) –আর এর মধ্যেই স্বদেশ সেন নিঃশব্দে লুকিয়ে রেখেছেন অনুরণনের এমবেডেড ম্যাট্রিক্স। প্রথম বাক্যের স্থানিকতা পেরিয়ে দোলা পেরিয়ে দ্বিতীয় বাক্য হয়ে উঠছে আনফরমুলেটেড সঙ। প্রথম বাক্যে আমরা পালকির শব্দ পাচ্ছি, দৃশ্যগত শ্রবণগত জরিপ যাচাই পাচ্ছি চলিষ্ণুতা পাচ্ছি কিন্তু পালকিকে দেখতে পাচ্ছিনা। পালকির ধারণাটিতে লেগে রয়েছে একধরণের দ্বিধাদ্বন্দ্বের টিউনিং অথচ দ্বিতীয় বাক্যে এসে একটা অ্যাবসিলিউট ইনঅডিবিলিটি, একটা সার্থক নৈঃশব্দ্য। সেখানেও একটাও পালকি নেই অথচ সেখানেই সমস্ত পালকি; সানন্দ-সমাপত্তি নিয়ে মনপাখি এবার উড়তে শিখে গেছে অনন্ত সম্ভাবনার আকাশে। যেন থাকার ঠিকানাটা খুঁজে পেয়ে গেছে সে, থাকাকে বিশ্বাস করতে শিখে গেছে। অদ্ভুত ক্ষণস্থায়ীতে না ভুলে বিশ্বের কালক্রমে আস্থা রাখতে শিখে গেছে সে আর এভাবেই কবির অভিজ্ঞতা হয়ে উঠছে কবির অনুভাব। সেখানে কোনো বিষয় নেই বরং স্মৃতির সঞ্চয় থেকে স্নায়ু অবধি নেমে আসছে ভার্চুয়াল একটা ক্ষেত্র, সেখানে কল্পনা আর অনুভবের একধরণের গতিময়তা কবির হাত থেকে নিয়ে কবিতাকে অস্তিত্বহীন নিয়তিহীন অফুরন্ত প্রবহের দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।

স্বদেশ সেনের কবিতার ঘরবাড়িতে ঢুকলেই এমনই সব Intuitive Pulsion খুঁজে পাচ্ছি আমরা। একক থেকে দানা থেকে যারা বারবার পুনর্গঠিত হচ্ছে অবচেতনার পর্যায় বদলে বদলে।  তৃতীয় ক্ষেত্রে সমস্ত পদগুচ্ছে “একজন” কে “সে” নামের একটা বিকল্প রিলেটিভ প্রোনাউন বা সম্পর্কসূচক সর্বনাম দিয়ে প্রতিস্থাপিত করলেন কবি। ভেঙে পড়ল “একজন”এর মধ্যে থাকা একটি মাত্র বিশেষ দৃশ্যের কথা। যেন কবিতার মধ্যে একটি একক বাধ্যতামূলক গ্রহণযোগ্যতাকে কিছুতেই মানতে চাননা স্বদেশ, বার বার পুনরাবর্তন চলে, রিকারশন চলে। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ‘যাদের যা ব্যথা ছিল’ ও ‘তাদের কি ব্যথা নেই’ এর মধ্যে আমরা পাচ্ছি একই বাক্যের একক গতিময়তায় একটি শব্দকে কেন্দ্র করে একধরণের কমপ্লেক্স হারমনি। প্রথম ‘ব্যথা’টি স্থির, কবির চেনা আর দ্বিতীয় ব্যথাটিকে কবি কোনোদিনও দেখেননি অথচ ওই অদেখাই তার কামনা। অর্থাৎ মাদার ইমেজ থেকে তাদের নিজস্ব logical regime থেকে শব্দকে নিয়ে স্বদেশ ফিরে যাচ্ছেন তার চিহ্নিত অর্থের বাইরে, শব্দ তখন কেবল একটা অন্য শব্দ নয় বরং সে তৈরী করছে তার একটা নিজস্ব স্বদেশ। ফরাসী কবি Pierre Reverdy কবিতার অন্তর্বতী ইমেজারি অ্যাসপেক্টের সপক্ষে বলেন- “The poet creates a strong image, new for the mind, by bringing together without comparison two distant realities whose relationship has been grasped by the mind alone…..The image is a pure creation of the mind; it cannot be born from a comparison, but from the bringing together of two realities more or less remote from one another.” – তেমনি স্বদেশের স্বীকারোক্তিও হয়ে উঠছে শব্দের ছবি ও প্রতিচ্ছবি আশ্রিত একটি সার্বিক চিত্রকলা; জীবন ও পরিবেশ থেকে যে অস্তিকে তিনি তুললেন তাকেই প্রাণআকুতি থেকে আবহমানের দিকে এগিয়ে দিলেন। স্থানিকতার ওপর আলো ফেললেন খানিকটা তেরছাভাবে যাতে চারদিকে চেতনা বিকীর্ণ হয় এবং সাব
কনশাসনেস হয়ে ওঠে ইউনিভার্সাল কনশাসনেস।
‘ম্যাগনেটিক রেসোনেন্স ইমেজিং’-এ দেখা যাচ্ছে চোখ আর আমাদের মস্তিষ্কের পেছনে থাকা ভিস্যুয়াল কর্টেক্সের পারস্পরিক সম্পর্কটা বেশ আশ্চর্য্যজনক। চেতনে যা দেখছি তা কিন্তু হুবহু সেই টেনর বা টেক্সচারে প্রতিফলিত হয়ে উঠছে না অবচেতনে। মানে একটা ক্যামেরায় তোলা চৌকো ছবি টেলিভেশিনের পর্দায় ফেললে যেরকম চৌকোই প্রতিস্থাপিত হবে এক্ষেত্রে কিন্তু তা হবে না। মেখে নেবে তারও সাথে আরও কিছুটা অস্থিতি আরও কিছুটা অধিক। আমাদের ফিল্ড অফ ভিউ এবং প্রাইমারি ভিস্যুয়াল কর্টেক্সের মাঝে লেগে রয়েছে কিছু সফিস্টিকেটেড ম্যাপিং, কিছু ভাবনাসুতো। এদের পারস্পরিক সম্পর্ককে কমপ্লেক্স লগারিদমিক ম্যাপ বলা হচ্ছে। এখন দৃশ্য ও দর্শনের মাঝে কতটা সম্ভাবনা আছে, সম্ভব থেকে অসম্ভবে কতটা তন্ময়ী অনুপ্রবেশ আছে তা কিন্তু নির্ভর করবে এই লগারিদিমিক ম্যাপের বিস্তৃতির ওপর। মানে অটুট অবিকৃত অন্ধকারে চোখ যে সময় আলোর একটা বৃত্তাকার বিন্ধু দেখে সেই একই সময় বিন্দু থেকে ভিস্যুয়াল কর্টেক্স অবধি গড়ে উঠছে একটি সরলরেখা আবার যদি দুটো সরলরেখা সচেতনভাবে একে অপরের সাথে মিশে একটি কোণ গঠন করছে তখন কমপ্লেক্স লগারিদমিক ম্যাপ সাথে সাথে তাদের বিভাজিত করে আরো দুটো সরলরেখায় পরিণত করে নিচ্ছে অথচ তাদের আপেক্ষিক কোণ একই থাকছে। অর্থাৎ দৃশ্যস্বরূপ হারিয়ে দৃশ্যকে সন্দেহ করার প্রবণতা বাড়ছে। স্থানিকভাবে তাদের কেন্দ্র একই জায়গায় থাকলেও সীমাসন্ধি পেরিয়ে তারা ক্রমশ বৃহত্তর আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। বিষয়ের ওপর দাঁড়িয়ে বিষয়ের মাধ্যাকর্ষণকে টানতে টানতে অতিরিক্ত ভাসমানতায় ভাঙতে ভাঙতে প্রাকসত্তার সাথে অনুসত্তার এই যে চিহ্নায়ন, এই যে ভাবনার রসায়ন তাকে কনফরমাল ম্যাপের (conformal map) সাথে তুলনা করা যায়। এটা অনেকটা জলবিভাজিকার মত। যেখানে একটি কনফরমাল বিন্দুতে একাধিক স্পর্শকের আপেক্ষিক কোণ এক রেখে স্পর্শকগুলির বিক্ষিপ্তি দেখা যায়। স্বদেশ সেনের কবিতার ডায়লেকটিকে দাঁড়ালেও প্রাথমিক ভাবে খুঁজে পাওয়া যবে এমনই একধরণের স্থির সুনির্দিষ্ট চেতনাকোণ, এবং সেখান থেকেই ক্রমশ ফেটে যাচ্ছে পূর্ণতা, একধরণের কনফরমাল পয়েন্ট যেখান থেকে একই নির্মাণের ছায়া ধরে ধরে রাস্তা খুঁজছে একাধিক নতুন বিনির্মাণের। যে যুক্তি ও অভিজ্ঞতা থেকে কবিতার সমগ্র অভিনিবেশ আমন্ত্রণ করছেন স্বদেশ সেন তার অতলে ডুব দিতেই কবিতা হয়ে উঠছে কৈবল্যের সন্ধান। কবির স্বগতকথন শতজল ঝর্ণার মত ছিটকে পড়ছে অন্নময় আত্মার দিকে আর তারা যেন অনুমতি চাইছে টুকরো টুকরো বিদেহীভাবনার। আর এভাবেই বাক যেখানে যায় না সেই অদৃশ্য অতীন্দ্রিয় অনির্বচনীয়তেই পৌঁছে যাচ্ছে স্বদেশের ‘স্বচ্ছতার রস’। স্বদেশ সেন তো বলেইছিলেন- “মানুষ তো একজন/ তার কতদিকে মন যায়/ চিন্তা করো, এই সর্বসাধারণ চোখে/সকল ও সূদূর এসে লাগে”। আসলে তিনি জানতেন শিল্প চিরচলিষ্ণু, একটি নির্দিষ্ট কালপর্বে নির্মিত হলেও তার মধ্যে একটা রাইজোম্যাটিক চেতনা রয়েই যাবে যা সুনির্দিষ্ট অনুশাসন কখনই মানবে না, আর এভাবেই বিশেষ কোনো মার্গ নয় বরং মনোভাবের খেলা নিয়ে কবিতার জোড়কে ভেঙেছেন স্বদেশ, তাকে দিয়েছেন নিয়তিহীনতা। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে দেখা যাক কীভাবে একটি কনফরমাল পয়েন্ট থেকে কোনোরকম কেওস ছাড়াই স্বদেশ সেনের কবিতা মোচড় নিচ্ছে প্রতিস্ব নির্মাণের তাগিদে, পরাবাস্তব নয়, সরল বিশ্বাসী বাস্তবের ভেতরেই রয়ে গেছে বাস্তবের পূর্ণনির্মাণ, বিন্দু বিন্দু প্রসারিত বীজক্ষেত্র। “কথা হয়েছিল” কবিতায় স্বদেশ সেন লিখলেন –
“এভাবে যে হিম দেখা দিলো/ কে বলবে অত:পর সে হিমের কী হল/ কেননা হিমেরও একটা কথা ছিল।”-

এখানে “হিম” সেই কনফরমল পয়েন্ট যা থেকে বোধটি বহুধা পাচ্ছে, পরিধির দিকে প্রসারিত হচ্ছে ; হিম থেকে কবিতার বহিরঙ্গের হারমনি ভাঙ্গছে, ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে পাঠক আর জীবনসত্য থেকে তার হাতে জীবনসূত্র তুলে দিচ্ছেন স্বদেশ স্বয়ং। ‘হিম’ কে দেখা দিল, ‘হিম’ এর কী হল এবং ‘হিম’ এর একটা কথা ছিল- একটি মাত্র শব্দকে কেন্দ্র করে তার অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ একই সাথে কতকগুলো মৃত ও জীবিত প্রান্তিক ছায়া নিয়ে স্বদেশ গড়ে তুলেছেন একধরনে গাঢ় জ্যামিতি, যেখানে সমতলগুলি সমীকরণগুলি সময়ের সাথে সাথে স্বতন্ত্র্যতা চাইছে। অর্থাৎ কাব্যিক স্কিমে একাধিক উপাত্তকে উসকে দিচ্ছেন স্বদেশ এবং এখানেই একজন কবি একজন পাঠক তার স্মৃতিসংস্কারকে ছাপিয়ে যেতে চাইছে, থামতে চাইছেনা বোধের একটিমাত্র পরিচিত প্রতিবেদনের কাছে। আবার “এসে যাওয়া” কবিতার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদটি দেখা যাক; -“আমাদের ভালোবাসা ধরা থাকে বড় হাতে হাতে/ এমন দাগের মতো ভালোবাসা কিছুতে থাকে না/ এত কাছে এসে পড়া- অতি দূরে ঝরে পড়া গুলি/ কেবল গাছের ফল, পাখি ডাকা পাখি ওড়া থাকে।”

 -‘ভালোবাসা’ নামের একটা থাকা একটা সমগ্র থাকা থেকেই কবিতাটা বহুরৈখিক হয়ে উঠছে, গোটা জগত সংসারকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে যেন প্রশ্ন তুলছেন জাগতিক দ্বৈততা নিয়ে আর এই প্রশ্নই অবিরাম সৃষ্টি করে চলেছে হাইপাররিয়েলিটি। কবিতার পোলারিটিকে ভেঙে দিয়ে সত্তাকে সর্বজনে খুঁজে পাবার অচেনা প্রত্যাশায় ভরে উঠছে কবিতা। ভালোবাসা যেন খুঁজে খুঁজে খুঁজছে দরজা, অথচ তার সামগ্রিক অনুভব নিথর দুর্বোধ্যতা ছাড়া আর কিছু নয়। স্বদেশ সেন এই ভালোবাসাতেই ভরে দিলেন কিছুটা ভাঙ্গন, চেতনার ইমিটেশন দিয়ে ভরে দিলেন রিসিভার ও ইমিটারের গ্রহণতত্ত্বটিকে। কবিতার সত্তায় অন্তসত্তায় গুলিয়ে দিলেন একধরণের অ্যাক্সিওম্যাটিক ট্রুথ। কত সচেতনভাবে তিনি দেখলেন না দেখাগুলোকে কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছাড়া প্রেডিকশন ছাড়া অথচ মনে হল এমনই তো হওয়ার কথা ছিল। থাকার পাশেই তো এসে দাঁড়িয়েছে না থাকা, ভালোবাসাকে তো ডাকছে ভালোবাসাই, কেবল আলোটা নেভালে যেমন তার অনুগামী ছায়ার বহর বেড়ে যায় তেমনি শিল্পীও তো একটা সমগ্রতাকে খুঁজছেন ; তিনি তো জানেন সত্তা অস্থায়ী, ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই, যা আছে তা কেবল বেঁচে থাকার স্পন্দন আর এই স্পন্দনকেই একটা আপেক্ষিক কোণ থেকে বিভিন্ন আকারে দেখতে চেয়েছেন স্বদেশ সেন। তাঁর কাছে ভালোবাসা হয়ে উঠেছে ‘সমস্ত দেখার দেখা’, ‘শোনার সমস্ত কিছু শোনা’। একই বিন্দু থেকে গুটি ভেঙ্গে বেরিয়ে আসছে বহুজাতিক বিস্ময়বাক, আর পুরো দেখার মধ্যে রেকারিং মোটিফ অফ হ্যালুসিনেশন থেকেই গড়ে উঠছে স্বদেশ সেনের নতুনের জ্যামিতি। মার্লামে বলেছিলেন- “The poetic act consists of suddenly seeing that an idea splits up into a number of equal motifs and of grouping them,; they rhyme.”- আর স্বদেশ সেন প্রেফার করলেন চেতনার রিফ্লেকশন, বললেন-‘কান দিয়ে কম শুনলে মন দিয়ে শোনা বাড়ে’। এই মনের চৌহদ্দীতে দাঁড়িয়েই তিনি মফঃস্বলের সীমানা পেরিয়েছেন, দেখতে চেয়েছেন বৈশ্বিক আয়তন, জানতে চেয়েছেন পিপাসার জলের মত ঘর –সংসার- ঘরোয়া থেকে কবিতা কিভাবে ভেঙে গিয়ে দুদিকে ছড়িয়ে যায় ।
দৈর্ঘ্য প্রস্থ আকার আকৃতি কনট্যুর এক্সটেনশন –তাঁর কবিতায় শব্দদের এতকিছুকে নিয়ে সত্তাকে অতিক্রমণের যে পরিসর তাতে কিন্তু এতটুকু ফাঁক নেই বরং ফাঁকগুলোকে ভরিয়েছেন ফাঁকের নির্ধারিত আদলে। থাবা দিয়ে লুফে নিয়েছেন না হওয়ার ভেতরের ক্রমশ হয়ে ওঠাকে। তাঁর কবিতারা একধরনের পলিহেড্রাল বা হায়ার ডায়মেনশনাল সেল দিয়ে ভরা। যার প্রতিটা কোষে জীবনের চটচটে সন্তান সন্ততি জন্মদিন টন্মদিন। স্বদেশ সেন যেন সেই মধুভৃৎ যিনি জীবনের চাক থেকে বারবার জীবনকে উসকে দিচ্ছেন জীবনানন্দের সংজ্ঞায়। দেখা যাক তাঁর কবিতায় কিভাবে আনসিনগুলোতে ট্রেক করছেন স্বদেশ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, -“যে-সকল অনুভূতি শ্রুতিগ্রাহ্য নহে, আমরা তাহাকেও ধ্বনিরূপে বর্ণনা করিয়া থাকি। সর্বপ্রকার শূন্যতা, স্তব্ধতা, এমন কি নিঃশব্দতাকেও আমরা ধ্বনির দ্বারা ব্যক্ত করি। আমাদের ভাষায় শূন্য ঘর খাঁ খাঁ করে, মধ্যাহ্ন রৌদ্রের স্তব্ধতা ঝাঁ ঝাঁ করে, শূন্য মাঠ ধূ ধূ করে, বৃহৎ জলাশয় থৈ থৈ করে, পোড়োবাড়ি হাঁ হাঁ করে, শূন্য হৃদয় হু হু করে, কোথাও কেহ না থাকিলে ভোঁ ভোঁ করিতে থাকে— এই সকল নিঃশব্দতার ধ্বনি অন্যভাষীদের নিকট কিরূপ জানি না, আমাদের কাছে নিরতিশয় স্পষ্ট ভাববহ; ইংরেজি ভাষার desolate প্রভৃতি অর্থাত্মক শব্দ, অন্তত আমাদের নিকট এত সুস্পষ্ট নহে। বর্ণকে ধ্বনিরূপে বর্ণনা করা, সেও আশ্চর্য। টকটকে টুকটুকে ডগডগে দগদগে রগরগে লাল; ফুটফুটে ফ্যাটফেটে ফ্যাকফেকে ধবধবে শাদা; মিসমিসে কুচকুচে কালো। টকটক শব্দ কাঠের ন্যায় কঠিন পদার্থের শব্দ। যে-লাল অত্যন্ত কড়া লাল সে যখন চক্ষুতে আঘাত করে, তখন সেই আঘাতক্রিয়ার সহিত টকটক শব্দ আমাদের মনে উহ্য থাকিয়া যায়। কবির কর্ণে যেমন ‘silent spheres’ অর্থাৎ নিঃশব্দ জ্যোতিষ্কলোকের একটি সংগীত ঊহ্যভাবে ধ্বনিত হইতে থাকে, এও সেইরূপ
।  আর স্বদেশ সেন লিখলেন - “মাঝ বালতিতে যা নেই, সেই মৃদু জলের শূন্য” কিংবা “উড়ো মতো উড়ে যাওয়াকে বলি চলে যাওয়া” অথবা পাতার ওপরে ওই ওই ওই পড়লো আমারই এক ফোঁটা –শূন্যতাকে সংযোজন করলেন সাধারণে, শূন্যতাকে ধ্বনিরূপে সংযোজন করতে চাইলেন, কেবল সংযোজনই নয় বরং শূন্যতাকেও দিলেন মরিয়া বাঁচার একধরণের মোমেন্টাম। স্বদেশ সেনের কবিতায় প্রবেশ করলেই বোঝা যাবে কীভাবে তাঁর সসীম বাক্যগুলো অসীম বাকহীনতা দিয়ে পরস্পরের সাথে ঘনসন্নিবিষ্ট। খন্ডকালোত্তীর্ণ হতে তাঁর কবিতায় একটি বাক্য প্রতিবেশী বাক্যের সাথে একধরণের হানিকম্ব প্যার্টান (মধুচাক) ক্রেভ করে চলেছে; ভাষার-চিন্তার-নির্মাণের স্প্যাসিয়াল গ্যাপ যাতে অব্যবহৃত হয়ে না থাকে তাই বৃত্তের বদলে কিছু ষড়ভূজাকার আকৃতির সমষ্টি হয়ে উঠছে তাঁর অভিজ্ঞতা ও সংবেদনগুলো। মৌচাকের মত ঘিরে রয়েছে প্রতিক্ষণ ও প্রান্তিকের সম্পর্কটি। স্বদেশ সেন তাঁর এই ইন্দ্রিয় উপাত্ত মৌচাকের মাঝেই পিছলে পিছলে খুঁজে বেড়িয়েছেন বস্তু ও দুর্জ্ঞেয় বোধির ভেতর সুর বাঁধার আয়োজনটি-খুঁজে বেড়িয়েছেন সেই একটি কবিতা যা পিন্ডেরও এবং ব্রহ্মান্ডেরও। এই সেই স্বদেশের নতুন প্রকল্প, আধুনিক প্রকল্প যেখানে ব্যপ্তিচৈতন্যে লিখনকে শিক্ষিত করে তোলার খেলা আমরা লক্ষ্য করতে পারি। মধুমক্ষিকার মত তাঁর বাক্যরা ; সারারজীবনের রস থেকে সূক্ষতম প্রকাশের দিকে ওড়বার ছটফটানি তাদের ডানায়, অথচ এক কোষ থেকে অন্যকোষে তাদের ঘিরে রয়েছে জন্ম ও গৃহস্থালীর কিছু অথিতিসেবা।  জ্যান্ত শব্দ কেটে বেরোতে চাইলেও জীবনের সাহচর্যে তাদের বেঁধে রাখছে অনবিচ্ছিন্ন চৈতন্য। স্বদেশ ফিরতে চাইছেন, নাগালের বাইরে বেরোতে চাইছেন, বহির্জগতের দিকে একধরনের ক্ষুধার উদ্রেগ হচ্ছে অথচ অন্তর্জগতে কারা তার হাত ধরে টানছে ! কে জানে ! ব্যবধানে যেতে চেয়েও বীজের কাছে থেকে যাওয়ার কল্পলতা স্বদেশ সেনের নির্মাণ বিনির্মাণের যুগপৎ প্রক্রিয়াকে একধরণের গ্রন্থিসূত্রে আবদ্ধ করে রেখেছে। স্বদেশ যেন জানতেন আমরা যে আলো জ্বালিয়েছি তা অন্ধকারকে ঠেকাতে পারবেনা, সেই অনালোকের আলো জ্বালিয়েছে অন্য কেউ অন্য কোথাও, তিনি যেন বুঝতে পেরেছিলেন আমরা যে রসের কথা বলছি সে কুটুম্বিতামুক্ত রস নয়, সেখানে পরিণতি আছে সমাধানের ইঙ্গিত আছে কিন্তু চ্যাটচ্যাটে চিদবৃত্তি নেই যা ‘সবুজ পোলের কাছে এসেই থেমে যাবে না’ বরং চিরকালীন বলে একটা ফেরার দিকে অগ্রসর হবে। এই দ্বন্দ্ব এই দ্বৈততা স্বদেশকে দিশাহারা করেছে তাঁর সামগ্রিক কবিতাযাপনে; মার্লামে শূন্যবাদের আশ্রয় নিয়েছিলেন আর স্বদেশ সেন সুন্দর দিয়ে তাঁর কবিতাদের ঘরবাড়ি সাজিয়ে দরজা রেখেছেন শূন্যের দিকে মুখ করে। ‘ব্রিজ পার হয়ে’ কবিতাটা দেখা যাক- দেখা যাক কবিতার তলায় তলায় কীভাবে থিতিয়ে রয়েছে একধরণের ন্যাচারাল অ্যাসিমেট্রি, একধরণের ইনার আর্ট পারফর্মেন্স। -

“ব্রিজ পার হয়ে যাবো- সুদূর অক্ষরে কাঁপা পথ
ঝুমকা থামো, আমি সাইকেলে চড়েছি
দূরে যাবো বলে। দুষ্টু পাতা কেন
ডাকো? কি কারণে জল তুমি শিশিরের মতো
নীরবতা! আকাশের কোণে কোণে পাখি নিয়ে খেলা
আকাশের। মেঘের মতন যাওয়া- এই যাওয়া ভালো।
আমার দুচোখে আর এ-ছাড়া কোথাও ভালো নেই
শুধু এই চলে গিয়ে থেমে যাওয়া কেন
সবুজ পোলের কাছে; একমনে ঝরে যাওয়া ভালো।”-

স্বদেশ সেনের কবিতার ভিত্তি মুলত তিনটি উপাত্তের উপর আশ্রিত। বাস্তব একটি পৃথিবী, চেতনার একটি পৃথিবী এবং একধরণের প্লেটোনিক ম্যাথমেটিকাল পৃথিবী। কবিতার সমস্ত শরীরে কিছু হেক্সাগোনাল কমপার্টমেন্টে এই তিন পৃথিবীর পারস্পরিক মেকানিক্সে গড়ে উঠেছে স্বদেশের স্বদেশ। বিষয়কে কখনই অস্বীকার করেননি স্বদেশ কিন্তু বিষয়ের মাঝেই অ্যাকমোডেট করিয়ে দিয়েছেন একধরণের বহিরাগমনের বার্তা। শব্দের বোধের অবাধ স্বাধীনতা কেবলমাত্র অস্থিতে সম্ভব নয় তাই কবিতাকে দিয়েছেন আরও একটা অতিরিক্ত নাস্তি। আছের শেষে একটা নেই। অনুপাতের শেষে একটা অসমানুপাত। একটা প্রতীক্ষমাণ। যাপনের রিফিউজি কলোনি থেকে নিজেকে বৃন্তবিচ্যুত করা। যাত্রী ও যাত্রার মাঝে অপেক্ষা করছে একধরণের এটার্নল রিটার্ন।


জ্যামিতি চিত্র দিয়ে ওপরের কবিতাটির অর্থ ও অভিধার পারস্পরিক বৈষম্য লক্ষ্য করতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই-‘দুষ্টু পাতা কেন ডাকো?’ বা ‘থেমে যাওয়া কোনো সবুজ পোলের কাছে’-এরা সেই বাস্তব জগত, কনশাস পৃথিবী, যার উপর দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে বুঁদ হয়ে যান স্বদেশ। আবার ওই হেক্সাগনাল বা ষড়ভূজের অন্যান্য কম্পার্টমেন্টে উঁকি দিলে দেখা যাবে উপনিষদীয় নির্জনতা যা বাস্তবের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে বারবার ফেরার দিকে ডাকছে। সেখানে অভীপ্সা মৃদু হতে থাকে। পার্থিব আলো নিমেষে উধাও হয়ে ছেড়ে রাখে কেবল তার স্মৃতি; পথ-গন্তব্যের জন্য আকুতি যার সেও এই চেতনা জগতে এসে কাউকে বলছে না পথকে অর্জন কর বরং বলছে মূর্তকে উত্তীর্ণ হও, আস্তিক্যভূমি থেকে ঝরে যাও একমনে। এখানে স্মৃতি আর বস্তুর নয় বরং বস্তু থেকে সে তখন ভাবের, সে বাস্তবকে পরিণত করেছে সংবিৎ-এ, সিদ্ধিতে। আবার ঠিক এই দুই পৃথিবী অর্থাৎ এই বাস্তব ও চেতনার জগতের মেরু ধরে গড়িয়ে নামছে স্বদেশের সেই অপার মধু, চটচট করছে সেই অনন্য কবিচিত্ত, এই সেই প্লেটোনিক ম্যাথমেটিকাল পৃথিবী যেখানে স্বদেশের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে আছে, অস্তিত্বঅনিস্তত্বসীমাঅসীমনিভৃতিব্যাকুল এমনই হাজার হাজার সমসম্ভাবনাময় প্রতিশব্দের সেটে নতুনের সাথে জড়াজড়ি করে আছেন স্বদেশ সেন। যেখানে অন্বেষণের পূর্ণতা চাননি স্বদেশ, সীমার সার্থকতা চাননি বরং আলোর উৎসবন খুঁজেছেন, মনের ভরা উজান খুঁজেছেন। সত্তাকে সম্পূর্ণভাবে পেতে স্বদেশ সেনের কবিতার নেপথ্যে সত্তাকে সম্পূর্ণরূপে জয়ের প্রেষণা কোথাও যেন ছিল, আর তিনি জানতেন তা সম্ভব ফেরার সম্ভাবনা দিয়ে নয় বরং তলিয়ে যাওয়ার স্বভাবজ দ্বিধা থেকেই; মৌচাকের মতই তাঁর কবিতায় এমনই কিছু স্যাকরেড জিওমেট্রি লুকিয়ে রয়েছে যারা একদিকে বিমূঢ় ও বিভ্রান্ত হয়ে রয়েছে জাগতিক বিকারগুলির মাঝে আবার অন্যদিকে মধুর টুকরো মুখে নিয়ে মানবজমিন ছেড়ে মহানন্দের দিকে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছে  পোষণ করছে। দ্বিমাত্রিক ত্রিমাত্রিক সন্ধিযোগে গড়ে উঠছে স্বদেশ সেনের চেতনার ঘর, সেখানে থাকা ও ফেরা দুজনকেই গেঁথে রাখা হয়েছে অলীক সংকেতে। বৃহদারণ্যকের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম  ব্রাহ্মণের ২০ শ্রুতির ব্যাখা করতে গিয়ে শঙ্কর দেখিয়েছেন – “জগতের বিকারগুলি ব্রহ্মেরই একদেশ বা অংশ, ব্রহ্মবস্তু আসলে এক, কেবল বিবিধ আকারে অভিব্যক্ত। ব্রহ্মকে যদি অংশী বলা হয় তবে জগতের তাবৎ বস্তুই তার অংশ আবার ব্রহ্মকে যদি অবয়বী বলা হয় তবে তাবৎ বস্তুকে তার অবয়ব বলতে হয়, কেন না অংশগুলির সমষ্টি করলে তবেই অংশীকে পাওয়া যায়।” স্বদেশ সেনের কবিতায় চেতনা ও অবচেতনার দূরত্ব ঠিক এতটাই যতটা বস্তুর ছায়াশরীরে জড়িয়ে থাকা বহির্ভূত ভৌতের, সে কিন্তু জড় নয়, স্বদেশের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তাকে ইন্দ্রিয় উপাত্ত করে তুলেছে, করে তুলেছে অভিজ্ঞতার অন্যস্বর।
অবীন্দ্রনাথ বলতেন- “জগত যার কাছে তার ছোট লোহার সিন্দুকটিতেই ধরা আর জগত যার কাছে লোহার সিন্দুকের বাইরেও অনেকখানি বিস্তৃত ধূলোর মধ্যে কাদার মধ্যে আকাশের মধ্যে বাতাসের মধ্যে, তাদের দুজনের কাছে সুন্দর ছোট বড় হয়ে দেখা যে দেয় তার সন্দেহ নেই ! সিন্দুক খালি হলে যার সিন্দুক তার কাছে কিছুই আর সুন্দর ঠেকে না, কিন্তু যার মন সিন্দুকের বাইরের জগতকে যথার্থভাবে বরণ করলে তার চোখে সুন্দরের দিকে চলবার অশেষ রাস্তা খুলে গেল, চলে গেল সে সোজা নির্বিচারের নির্ভয়ে। যখন দেখি নৌকা চলেছে ভয়ে ভয়ে, পদে পদে নোঙ্গর আর খোঁটার আদর্শে ঠেকতে ঠেকতে, তখন বলি, নৌকা সুন্দর চল্লো না, আর যখন দেখলেম নৌকা উলটো স্রোতের বাঁধা উলটো বাতাসের ঠেলাকে স্বীকার করেও গন্তব্য পথে সোজা বেরিয়ে গেল ঘাটের ধারের খোঁটা ছেড়ে নোঙ্গর তুলে নিয়ে, তখন বলি, সুন্দর চলে গেল”- বাংলা কবিতায় স্বদেশ সেনের নিরীক্ষা সনাতনী স্বরের নোঙরটিকে এভাবেই তুলে  প্রশ্নভারাতুর পাঠককে নিয়ে গেছে কোনো এক নিরুদ্দেশ যাত্রার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ব্যাকরণ থেকে কোনোভাবে চূর্ণ হননি স্বদেশ বরং কবিতার সীমিত প্রকাশকে প্রসারিত করতে নতুন ব্যাকরণ বানিয়েছেন, বানিয়েছেন বয়নের বহুবিচিত্র সম্ভাবনার ক্ষেত্র; দেখা যাক আশির দশকে স্বদেশ সেনের কবিতার সেই নব্যব্যাকরণ যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক নতুন ভাষাসামর্থ্য, গড়ে ঊঠেছে সনাতনী স্মৃতিসংস্কার পেরিয়ে তৎপরবর্তী কয়েক দশকের কবিতায় অক্ষরের সাড়া দেওয়ার ধরণটি। রুশ আঙ্গিকবাদী ও ভাষাতাত্ত্বিক রোমান ইয়াকবসন কবিতার ভাষা প্রসঙ্গে বলতেন –“Poetry is an organized violation of language”.তাঁর রচিত “Closing statement: Linguistics and Poetics” তে তিনি দেখান কবিতার ভাষায় কেবল ধ্বনিই নয়, বাক্যের মাঝে অর্থের সামঞ্জস্য বা অসামঞ্জস্যও কবিতাকে করে তোলে রহস্যময়, কবিতার শরীরে লেগে থাকা এধরণের দ্বৈততা বাক্যের ভেতরের সমান্তরাল ভাবনাগুলির সাথে ওতপ্রোত ভাবে গাঁথা থাকায় সর্বদা নতুন কিছু একটা খোঁজ নতুন কিছু একটা দেখা নতুন কিছু একটা ঝুঁকি গড়ে ওঠে কবির অন্বেষায় এবং বিশ্লেষণী পাঠকের মনে মননে। ইয়াকবসন বলছেন- “Poetry is not the only area where sound symbolism makes itself felt, but it is a province where the internal nexus between sound and meaning changes from latent into patent and manifests itself most palpably and intensely. The super average accumulation of a certain class of phonemes or a contrastive assemblage of two opposite classes in the sound texture of a line, of a stanza, of a poem acts like an ‘ undercurrent of meaning’. A reinforcement of this contrast by surrounding the first word with acute and sharped phonemes, in contradistinction to a grave phonemic neighborhood of the second word, makes the sound into a thorough echo of the sense.”- ১৯৮২তে কৌরব থেকে প্রকাশিত হল স্বদেশ সেনের “রাখা হয়েছে কমলালেবু”। প্রথম কবিতায় তিনি লিখলেন- “কোথায় এক পরিবর্তন/প্রচল থেকে কোথায় আছে অন্য/অরুণা যায় থেকে অরুণা আসে/এই সামান্য মুদ্রায়/দিনরাত ও শরৎ হেমন্ত সব যায়/ জন্ম পংক্তি থেকে একটা লাইন পড় / সারা সৃষ্টিতে এই প্রথম একবার কাজ/ পড় এমন করে, এমন অসাধারণ পড়/ যা মৃত্যুচিৎকার থেকে বড় ও সমানে ছড়িয়ে যায়”- স্বদেশ সেনের কেন্দ্রীয় চেতনার প্রতিটি পরিসরই যে প্রথম থেকেই নতুনের পাটভাঙা দিগনির্দেশ খুঁজছিল তা আমরা এ কবিতা থেকেই টের পাই-  দ্বিতীয় লাইনে ‘প্রচল’ ও ‘অন্য’ পরস্পর বিপরীত অর্থনির্বাহী শব্দ অর্থাৎ অ্যাসিমেট্রিকাল প্রবণতা স্পষ্ট অথচ তারাই গড়ে তুলল ভাষার বোধের একধরণের সংহত সিমেট্রি। যেন ‘প্রচল’ শব্দটাকে আশ্রয় করেই ‘অন্য’ শব্দটি তার নিজস্ব বৃত্তি পেল। যেন বিশৃঙ্খলার মাঝেই গড়ে উঠল শৃঙ্খলার অনুপম। একেই কি ইয়াকবসন বললেন “ভাষার সুসংহত বিস্ফার”? দুটো বাহ্য প্রতক্ষের বৈপরীত্যে গড়ে ওঠা একধরণের প্রকল্পনা যেখানে পরবর্তী শব্দটি ধরে রয়েছে পূর্ববর্তী শব্দটির অনুরণন, তার না পাওয়াগুলি, ধরে রয়েছে তার সংগঠন ও বিভাজ্যতাগুলি। শেষ লাইনে এসে স্বদেশ সেন উচ্চারণ করলেন আরও এক অমোঘশব্দ আরও এক কনট্রাস্টিভ ব্যাকগ্রাউন্ড। লিখলেন- “মৃত্যুচিৎকার” শব্দবন্ধটি! মৃতের বাতাবরণে এতো জীবিতের সংলাপ! মাধ্যাকর্ষণের মানুষের ভিতরে তবে কি দম নিচ্ছে আদতে একটি মহাশূন্যতা ! এই সেই বাক্যের ভেতরে শব্দবন্ধের ভেতরে পারস্পরিক বৈপরীত্যে গড়ে ওঠা নান্দনিক আঁতাত যা দৃশ্যপরিবেশকে আরও গভীর আরও গ্রহণযোগ্য করে তোলে, পাঠকে টেনে ধরে গোড়ার দিকে। স্বদেশ তাঁর নতুনের খোঁজে প্রথম থেকেই এভাবে পর্যবেক্ষণকে নিয়ে গেছেন প্রাজ্ঞতার দিকে। পাশাপাশি দুটো শব্দের সিস্টেমাইজ কনফিউশন থেকেই গড়ে তুলেছেন একধরণের অতীন্দ্রিয় কারুকল্প। তাঁর সামগ্রিক কাব্য সংকলনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এ ধরণের ফোনেমিক শিফট বা ফোনেমিক অপজিশন। পাশের ছবিতে স্বদেশ সেনেরই বিভিন্ন কবিতার তিনটি বাক্যের সপক্ষে আমরা দেখাতে পারি বাক্যের ভেতর লুকিয়ে থাকা এমনই বৈপরীত্য-

পাঠক যে মুহুর্তে ১ নং বাক্যের কাছে বসবে ওমনি সে স্বাভাবিকতার তাড়ণায় বা অসহায়তা নিরুপণের তাগিদেই ‘সামগ্রিক রং’ থেকে উদ্ধার করতে চাইবে ‘আসল রং’, অথচ এর মধ্যেই স্বদেশ লুকিয়ে রেখেছেন খোয়ানোর প্রগাঢ় তামাশা কিংবা ২ নং এ “এক হাত জায়গা” নিশ্চিত করতে অনিশ্চিত করতে হবে “দু হাত জায়গা” কে অর্থাৎ প্রকৃত পাওয়ার চেহারাকে ঠাহর করতে বহিরান্দ্রিয়গ্রাহ্য উপরিতলের সমাহারকে ফেলে আসতে হবে চাক্ষুষ জ্ঞানের জগতে। একই শব্দের মধ্যে সেমানটিক শিফট ঘটিয়ে স্বদেশ আদতে শব্দগুলোর মানসিক জোর বাড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁর নিরীক্ষা স্থানিকতা বদলে বদলে প্রতিটা শব্দে এনেছে নতুন রহস্যময়তা। ৩ নং বাক্যে অর্থের স্পষ্টতা ও অস্পষ্টতায় গড়ে উঠছে একধরণের গুহ্যতা, পোয়েটিক সাউন্ড টেক্সচার, যাতে একটি আবর্তনের মধ্যে বিপরীত আবর্তনকে ফুসলিয়ে দিচ্ছেন স্বদেশ। অর্থাৎ আমির মধ্যেই অনেক মাত্রা, জড়িয়ে থাকার মধ্যেই বিচ্ছিন্ন থাকা আর পৃথিবীর সমগ্রতায় কবি সেই পাঁকাল মাছ যিনি কবিতার জীবন্ত শরীরে শব্দের ক্ষণকালীনতা পেরোতে চাইছেন বারবার, পিছলে যেতে চাইছেন বারবার। এইভাবে পাশাপাশি দুটো বিপরীতধর্মী শব্দের মাঝে সৃজনের মুক্তরূপ সৃষ্টি করেছেন স্বদেশ সেন। যার ফলশ্রুতি তাঁর কবিতায় ধ্বনি নিয়ন্ত্রিত বাচনিক চিহ্ন দিয়ে গড়ে ওঠা প্রকাশের পৃথিবী আরও গতিশীল ও সীমাহীন হয়ে উঠেছে। বাক্যে অনুপ্রবেশের সাথে সাথে শব্দের বোধের আঞ্চলিক তন্ময়তা পেরিয়ে পাঠক খুঁজে বেড়িয়েছে একধরণের অশ্রুত অননুভূত উৎসুক অপার। নতুন বন্দীশে বন্দী হয়েছে পাঠকের প্রাথমিক রংগুলি। আর শব্দ থেকে নৈঃশব্দ্য অবধি যেতে স্বদেশ সেন তাঁর কবিতার অন্তস্তলে এভাবে অনূদিত করে গেছেন যাপনের একাধিক অস্থির বিন্যাস।
নতুন কবিতা মানেই যে প্রচলিত সাংগঠনিক কাব্যতত্ত্ব থেকে সম্পূর্ণ প্রস্থান তা স্বদেশ সেন কখনই বিশ্বাস করতেননা; বরং তাঁর প্রত্যাশা ছিল সীমাহীনতার। সীমিত ব্যাকরণকে তার অন্ত্য উপাদানগুলিকে নিরন্তর পরীক্ষা নিরীক্ষায় তিনি প্রসারিত হবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। স্বদেশ সেন বলতেন- “দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করি যে, আজকের তরুণতমদের কেউ কেউ বিষয়কে বাদ দিয়ে লিরিক ছেঁটে ফেলে, বিশেষণ সীমিত করে, ক্রিয়াপদকে দমিয়ে রেখে, চিত্রকল্পকে ‘ডিমোট’ করে, ছন্দের সমস্ত বেড়া ভেঙ্গে ফেলে, কবিতার রহস্যের অবহেলা করে এবং শেষে কবি ও পাঠকের মধ্যে যোগাযোগের সেতুকে ভেঙে ফেলে কোথায় চলেছেন, বুঝতে পারি না।” -আর পাঠক লেখকের এই জাতীয় যোগাযোগের স্থায়ীত্ব চেয়ে তিনি জোর দিয়েছিলেন ভাষার অধোগঠনের উপর। অর্থাৎ অধিগঠন যা বাস্তব তার বিমূর্ত রূপেই কবিতার সাথে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছিলেন স্বদেশ সেন। কারণ একমাত্র বিমূর্তই পুষ্ট করতে পারে বহুত্বের দিকগুলোকে। প্রকৃতির মাঝে প্রাকৃতজের মাঝে কবিতা অক্ষুন্ন রাখতে চায় তার আপন অস্তিত্বকে, আপন বংশপরম্পরাকে, কিন্তু বাইরে থেকে টান এলে সে বিশ্বমূলে বেরিয়ে পরে অনিশ্চিত দর্শন নিয়ে আর এভাবেই কেটে যায় কবিতার পিছুটান, কেটে যায় পুনরাবৃত্তির নাগাল, স্বদেশ সেন তাঁর কবিতাকে কোনো অভেদ্য দেহ দেননি, তার শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে চাননি একটিই মাত্র একক মেরুদন্ড বরং ছিন্নভিন্ন কিছু ছবি আর সেই “ছিন্নভিন্ন ছবিকে ছবি করাই কবিতা” হয়ে উঠেছে। কোনো ব্যাকরণিক ফতোয়া নয় বরং নতুন ভাষার জন্য গড়ে তুলেছেন কিছু নতুন ব্যাকরণ। চমস্কি নির্মিত সঞ্জনন ব্যাকরণে পূর্ণাঙ্গ একটি বাক্যের সংগঠনে আমরা অধোগঠন বা Deep Structure of Language ও অধিগঠনের বা Surface Structure of language মত দুটি উপাদান পাই। এই অধিগঠন হল মূর্ত বাক্যটি আর অধোগঠন অর্থের উপাদান নিয়ে ক্রমশ তলিয়ে যাওয়া বোধের ব্যপকতাগুলি যা নির্মাণকে সম্প্রসারিত চেতনায় পরিণত করে। এখন এই সারফেস স্ট্রাকচার থেকে ডিপ স্ট্রাকচারে যেতে কবিতাকে প্রসঙ্গমুক্ত করে তুলতে বা নৈর্ব্যক্তিক করে তোলার পদ্ধতিকেই চমস্কি বলছেন সংবর্তণ। একটি বাক্যের গঠনকে পুরোপুরি ভেঙে ভিন্ন একটি গঠন দেওয়া যায় বা ভাষার ক্ষুদ্রতাকে পেরিয়ে প্রত্যক্ষের স্পষ্টতা পেরিয়ে ভাষাকে দেওয়া যায় একধরণের বিভাজক রহস্যসৌন্দর্য্য। স্বদেশ সেন তাঁর গঠনের ভাষায় চিহ্নিত করেছেন এইজাতীয় চিন্তার বিশৃঙ্খলাগুলোকে। প্রতিষ্ঠিত ধারার প্রতিষ্ঠিত চিহ্নগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোতে আমরা লক্ষ্য করতে পারি সংবর্তনের অসাধারণ কিছু ওলোটপালট যা তাঁর নিজস্বতার বার্তাবহ। বিলোপন (Deletion), সংযোজন ( Insertion), বিকল্পন ( Substitution) বা স্থানান্তরণের (Movement) মত সংবর্তনের বিবিধ প্রক্রিয়াতেই সাংবিধানিক ব্যাকরণের সরাসরি অনুসরণ না করে স্বদেশ সেন আরোপ করেছেন একধরণের নিজস্বতা একধরণের নতুন শৈলী সংগঠন। তাঁর প্রকাশভঙ্গিমাকে জীবিত ও সৃষ্টিশীল করে তুলেছেন তাদের স্বাভাবিক সূত্রায়ন ও বিন্যাসটিকে ভেঙে ফেলে। স্বল্প পরিসরে তাঁর একটি মাত্র কবিতার ওপর সংবর্তনের বিবিধ প্রক্রিয়াগুলির কিছু আলোচনা আমরা করতে পারি। “হে অনেক” কবিতায় তিনি লিখলেন- “হে অনেক আমগাছের দেশ/ তোমার এক মুহুর্ত ভালো লাগছে/ভালো লেগেছিল তোমার সদাসর্বদা/এই সেই কখনো সখনো সময়/ ভালো লাগছে এর পরিমাণ ও আয়তন/সব রকমের মাপ ও বায়ুসহিত জল/আরো অনেকদিন ধরে বরাবরের ফুল তোমার।/ নদী নামের কাছেই দেখো ভালো আছি/ এই আবার ভালো আছি, হে অনেক আমগাছের দেশ।”- প্রথমত শেষের আগের লাইনে আসা যাক- “নদী নামের কাছেই দেখো ভালো আছি” এর মধ্যে একটা লিংগুয়িস্টিক ট্রপিকালাইজেশন বা সংবর্তনী স্থানান্তরীকরণ (Movement) পাওয়া যাচ্ছে অর্থাৎ ক্রিয়াপদের স্থানান্তরিকরণে শব্দের মগ্ন গঠনে জোর দেওয়া হল। স্বাভাবিকভাবে বলা যেতেই পারত-“ভালো আছি দেখো নদী নামের কাছেই” যা সচরাচর স্বদেশের কবিতায় দেখা যায় কিন্তু স্বদেশ ‘ভালো আছি’ ক্রিয়াপদকে এক্ষেত্রে  সরিয়ে দিলেন বাক্যের শেষে আর নদীকে নিয়ে চলে এলেন বাক্যের একেবারে শুরুতে অর্থাৎ অস্তিত্বকে, যাপনের অবস্থানগুলিকে দেখতে চাইলেন গন্তব্যের হিল্লোলে, জোর দিলেন নদী নামের সীমাহীনতাকে। এখানেই স্বদেশের নতুন-বাক্যের ভেতরকার আভ্যন্তরীন তাৎপর্যে তিনি একজন পাঠক বা কবিকে আগোছালোভাবে ঘোরাফেরা করতে শিখিয়েছিলেন। আবার কবিতাটির শুরুর লাইনে আমরা সংযোজনী সংবর্তনের (Insertion) উদাহরণ পাচ্ছি- “হে অনেক আমগাছের দেশ” - এখানে “হে” শব্দটির সাথে “আমগাছের দেশ” এর কোনো অর্থগত অভিন্নতা না থাকলেও হে শব্দটি একটি অনুক্ত কর্তার মতই অধিতল কর্তা “আমগাছের দেশ” কে নির্মাণের আলো দিচ্ছে। এবং অধিতল কর্তার সীমাবদ্ধতাকে ওই ‘হে’ নামের অনুক্ত কর্তাটা সমুদয়ের দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে পাঠকের নিজের হয়ে উঠছে আমগাছের দেশ, পাঠক বসবাস করতে চাইছে ওই নির্মিতির ভেতর। আবার কবিতার মধ্যে পারস্পরিক বাক্যে একই সাথে স্বদেশ সেন খুলে দিয়েছেন স্থানিক ও কালিক কিছু স্ববিরোধ কিছু বৈপরীত্য। একধরণের স্থিরতার ভেতর প্রকাশিত করেছেন প্রবেশাধিকার দিয়েছেন একধরণের অফুরন্ততাকে যাকে আটকানো সম্ভব হবে না। অর্থাৎ একই সাথে চলমানতা বা Progressive Aspect ও সমাপ্তি বা Perfective aspect এর সম্প্রসারিত ভাবনাগুলোর সাথে বাঙ্গালী পাঠককে অভ্যেস করিয়েছেন স্বদেশ সেন। যেমন আলোচ্য কবিতায়  ৪ ও ৫ নং বাক্যে আমরা পাচ্ছি- “এই সেই কখনো সখনো সময়/ ভালো লাগছে এর পরিমাণ ও আয়তন” এ “এই সেই কখনো সখনো সময়” তে একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের প্রসঙ্গ উঠে আসছে অর্থাৎ পারফেকটিভ অ্যাসপেক্ট ভেসে উঠছে সময়ের সংজ্ঞায়।  অথচ তার পরিমাণ ও আয়তন নিয়ে যে ভালো লাগার কথা পরের লাইনে উচ্চারণ করলেন স্বদেশ, তার ব্যপ্তি অনন্ত, অসীম, সে ইন্দ্রিয় মন আর মনীষা হয়ে রসের দিকে ক্রমপ্রসারিত। এভাবে বাক্যের অস্তিত্বকে সত্তাকে আলাদা করেও স্বদেশ সেন তাদের মধ্যে দিয়েছেন একধরণের অলীক সংগম যা নতুন ভাষার অতিচেতনা হয়ে উঠেছে। তাছাড়া যে বাংলার সার্বিক ব্যাকরণে ক্রিয়া অন্ত্য তাকেই বাক্যের বিভিন্ন স্থানে স্থানপরিবর্তন করে স্বদেশ সেন তাঁর নতুন কবিতাক্রম তৈরী করলেন; উপরিক্ত কবিতাতেই আমরা লক্ষ্য করতে পারি ৩, ৫ ও ৯ নং বাক্যের শুরুতে ক্রিয়ার অবস্থান পুরো বাক্যকে একটা সজীব বস্তু করে তুলেছে। শুধু এই কবিতাতেই নয় স্বদেশ সেনের একাধিক কবিতাতে কর্তা বা কর্মের ঊপর ক্রিয়ার কর্তৃত্ব, যার ফলে একটা হওয়া একটা চলমানতার অন্বেষা একটা মোমেনটাম গতানুগতিক বাংলা কবিতার নিষ্প্রাণ শরীরে সুনির্দিষ্ট অর্থে নিয়ে আসে একধরনের নড়াচড়া, সংক্রমণ ও সঞ্চলন। যেমন-

    ≥ “ এক পাখি ওড়ো, তুমি আর পাখি/ ফিরে ওড়ো হাজারের দিকে”
    ≥ “ কি ভাবে যে খেলে গেছে শরতের যত ভালো/ যত আলো”
    ≥ “ভরে উঠেছে আমার ভেতরে এভাবে কতদিন”
    ≥ “ একা যায় চলে যাওয়া খোলামেলা বড় কুয়াশায়”
    ≥ “গুঁড়ো হয়ে পড়ছি গরমে তাতে মেঘের গায়ের ধুলো।

প্রতিটা বাক্যেই রিনিউড ফোনেটিক্স পেয়ে যাই বাক্যের ভেতর বাক্যের উপাদানগুলির এভাবে গুলিয়ে যাওয়ায়। স্বদেশের সামগ্রিক কবিতালিপি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে প্রতিষ্ঠানীয় ক্রিয়ার সংস্কার ও শাসনে ঢিল ছুঁড়লেন ক্রিয়ার নতুন ও অভিনব ব্যবহার নিয়ে, যা কবিতাকে কেবল বর্ণচোরা ইন্দ্রিয়তাই দিলনা বরং উচ্চারণে দিল একজাতীয় মুক্ততা; ক্রিয়ার এই অবস্থানগত মূল্য স্বদেশ সেনের কবিতায় অপার যা পরবর্তীকালে ভাষা বা শব্দের মিথ থেকে বেরোতে সাহায্য করেছে নতুন কবিতাকে।
এছাড়াও স্বদেশের কবিতায় বাক্যের মধ্যেই চলছে বাক্যের নিরন্তর প্রসারণ, বাক্য থেকে তৈরী হচ্ছে নতুন বাক্য এবং নতুন বোধ –আর এসবই হচ্ছে বাক্যের মধ্যে কিছু নির্দেশকের অন্তর্ভূক্তির জন্য। কয়েকটা উদাহরণ দিয়ে আমরা এই বিন্যাসকে তুলে ধরতে পারি; উদাহরণ হিসেবে আমরা প্রাথমিকভাবে সনাক্ত করি “কিভাবে কখন” কবিতাটির তিনটি বাক্যকে –

  √“কোন এক নীরব ও নিয়ত কথা আছে”
  “সবই কোন একদিন দ্বিপ্রহরে শব্দ হয়ে আসে।”
 “বিশ্বাসে যখন হাত পড়ে, আমাদের, কীভাবে সমস্ত ছেড়ে যায়”।

এবার নিচের ব্যাখ্যাচিত্রে দেখা যাক বাক্যের সাথে বাক্য যোগ হয়ে কীভাবে একধরনের ম্যাট্রিক্স সেনটেনস তৈরী হচ্ছে স্বদেশ সেনের কবিতায়। -

অর্থাৎ বাক্যের ভেতরে রয়েছে বাক্যের অন্ত্যভাষা এবং তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে কিছু প্রসারিত অন্বয় দিয়ে। ‘নীরব ও নিয়ত কথা আছে’ এই সেই বাক্যের আর্তি কিন্তু তার আগে ‘এক’ এর মত স্থির ও ‘কোন’ এর মত অস্থির দুটো শব্দ দিয়ে বাক্যের মধ্যে দেওয়া হল একটা আনএনডিং কম্যুউনিকেশন। শব্দের বাস্তবিক প্রামাণ্যের মাঝে প্রেজেন্ট কনটিন্যুয়াস করে তোলা হল নৈঃশব্দের মিস্টিক মোরামকে। কবিতায় চেতনে অবচেতনে স্বদেশ নিজেই পাঠককে হাত ধরে ধরে নামিয়ে আনছেন ক্যাটাগরি মিসটেকে। তারা যাতে আঁচড়গুলোকে দেখতে পায়, আঁকবার মত এচিং খুঁজে পায়। যেটুকু দেখছেন তা একটা প্রাকৃতজ দৃশ্য অথচ তার বাইরেও দেখার জন্য রাখছেন বোধের স্প্যাসিয়াল প্রপার্টিস। ‘কবিতার নিঃস্বতাকে বাড়িয়ে রাখছেন” প্রজ্ঞানের পরিপূর্ণতার দিকে ইশারা রেখে।
বিনয় মজুমদারের মত পরিমিতি ক্যালকুলাস ডেরিভেটিভস বা বীজগণীতিয় কোনো গাণিতিক কাঠামোর উপর স্বদেশ সেনের কাব্যভাবনা গড়ে না উঠলেও সত্তর আশি দশক থেকে স্বদেশের যে নতুনের খোঁজ যে নতুন শৈলী ভাবনা নতুন লয় ও যতির গ্রন্থনা তাতেও কিন্তু চিন্তনের একজাতীয় সচেতন গণিত পাওয়া যায়। বিনয় তাঁর কবিতায় “বিজ্ঞানের মনুষীকরণ” ঘটিয়েছিলেন, পেতে চেয়েছিলেন কল্পনার অসীমকে ধারণাযোগ্য বাস্তবে আর স্বদেশ সেন ধারণাযোগ্য বাস্তবের মাঝেই খুঁজলেন “দহরং পুন্ডরীকং রেশ্ম” অর্থাৎ অন্তর্হৃদয়ের সেই ছোট একটি একান্ত ঘর যেখানে অসীম উদ্ভাসিত সত্য হয়ে আছে।  দুজনার কবিতায় বিস্তর ফারাক থাকলেও দুজনেই আত্মজিজ্ঞাসিত কবি, দুজনার ব্যক্তিগত কথ্যও কোথাও যেন ‘আমি’ ও ‘তুমি’ র মাঝে কেবল বিবৃতি নয় বরং বিপুল ও প্রবল নিয়ে বিস্ময়ে নীরব হয়ে আছে। বস্তু এবং বিশ্ব-এর যোগফল বিয়োগফল কিংবা গুনফলের মাঝেই চয়ন হয়ে রয়েছে দুজনের সীমা তত্ত্বের ব্যাখা। সীমার সন্দর্ভে সবসময় একটা অস্থায়ী সত্তা, যে ইন্দ্রিয়জাত বাস্তবিক আবিষ্কৃত সত্যটি লক্ষ্য করছে অথচ সে নিজেই স্থায়ী সত্তা নয়, একধরণের অনাবিষ্কৃত ভোকাবুলারী রয়ে গেছে তার নিজেরই ভেতর। নিজেরই বাইরে সে একটা প্রকৃত আবিষ্কার সে একটা সংশয় –বার্ট্রান্ড রাসেল বলতেন- “অনিশ্চয়তাকে স্বীকৃতি দিয়ে সিদ্ধান্ত না নেওয়ার ক্ষমতা অর্জনের জন্য যে বিদ্যাটি চর্চার সবচেয়ে উপযোগী তার নাম দর্শন। হ্যাঁ, বিনয় মজুমদারের পর স্বদেশ সেনই বোধহয় সেই চরম আত্মজিজ্ঞাসু কবি যিনি বারবার নিজের ভেতরই নিজেকে ভেঙেছেন খন্ড বিখন্ড সত্য সুন্দরে; নিজের দর্শনকে দিশারী করে তুলেছেন। বাঁধাবাঁধি প্রত্যক্ষতা পেরিয়ে বিশ্বটাকেই পরীক্ষা করতে আগ্রহী হয়েছে স্বদেশের সমীকরণ। অসীম বিভাজ্য কিনা এ প্রসংগে বিনয় মজুমদারের প্রকৃত প্রস্তাব “গ্রন্থি” র সাথে তাঁর সাক্ষাৎকারেই আমরা পেতে পারি। ‘সমান সমগ্র সীমাহীন’ এর যে কবিতায় তিনি লিখেছিলেন- “একটি বিড়ি ধরিয়ে সেই পোড়া দেশলাই/ কাঠি দিয়ে আমি/ টেবিলে লিখেছিলাম অসীম এক নং যোগ অসীম দুই নং যোগ অসীম তিন নং যোগ ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা....../ পেলাম অসীম সিংহ/পেলাম অসীম বালা, অসীম মজুমদার/ পেলাম অসীম রায়, ভাইরে/অসীম।” সেই কবিতায় একধরনের ‘অলংকৃত জিজ্ঞাসা’ বা rhetorical question এর সামনে তিনি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন। অস্তিত্বের ধারণা কেন কেবল দ্বিমাত্রিক বা ট্যু ডায়েমেনশনাল হবে?  কেন আর একটা মাত্রা জুড়ে দিয়ে তাকে ত্রিমাত্রিক করা যাবে না! এই ছিল বিনয়ের প্রশ্ন। মাটির ওপর এঁকে ফেলা জমিটির দৈর্ঘ্য প্রস্থ এর ওপর যদি সাহস করে বিশ্বাস করে আরও একটি মাত্রা জুড়ে দেওয়া যায় তাহলে তো সে আকাশের দিকেও অসীম মাটির দিকেও। এই উচ্চতাই কবির বিশ্বাস কবির কল্পনা, সীমাবদ্ধ সসীমের মহত্ত্ব লুপ্ত করে অসীমের মুক্তির সাথে সম্পর্কযুক্ত করে তোলার প্রয়াস। আর স্বদেশ সেন অসীম বিমূর্ততার সাক্ষাৎকারে মিল দিয়ে মিলিয়ে দিলেন সসীমের মেলামেশাকে, মেলামেশার মধ্যে ঢুকে পড়লেন, যোগ করলেন অনেক মিল আর পেয়ে গেলেন মিলনসার। পেয়ে গেলেন বাংলা কবিতার সেই অমৃত আনন্দলোক যেখানে আলো কখনও নেভে না।
জর্জ বার্ণাড শ বলতেন- “Life is no brief candle for me. It is a sort of splendid torch which I have got hold of for the moment, and I want to make it burn as brightly as possible before handing it on to future generations.”-  স্বদেশের কাছেও কবিতা কোনরকম কবিরাজি ছিলনা যে বুকব্যথা বললেই সেরে যাবে বরং তাঁর দীর্ঘ কবি জীবনে তিনি নিরীক্ষা পরীক্ষার ক্যান্ডেলটি জ্বালিয়ে গেছেন ভবিষ্যতের অভিনিবেশ থেকে। যেন নতুনের নাছোড় এক অনুরাগী যিনি নতুনের সুরম্য মীমাংসা চাননা কোনওদিনও। সমন্বিত মুখ আর মাটি মাখা পৃথিবীতে একজন দ্রষ্টা আঁতিপাঁতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন একটাই প্রশ্ন- “how he coming into this realization” –থাকা মানে যার কাছে পুরোটাই আনন্দ আর নতুন মানে যার কোনো দুঃখ নেই। স্বদেশের প্রাণের গোড়ায় ছিল বিশাল একটা খোঁজ-অক্ষরের আদ্যপান্তের সেই অস্থায়ী জীবনের খোঁজ; প্রকৃত অর্থেই স্বদেশ সেন নতুন; নো
অ্যামবিগিউটি নো অ্যামালগেমশন-নিজেকে পূর্ণ করতে নিজেকেই রিক্ত করেছেন বারবার, সেখান থেকেই লিখে রেখেছেন-“শব্দের পাড়ায় আমি মাঝে মাঝে যাই চরিতার্থ হতে” আর আশির দশক থেকে আজ অবধি বাংলা কবিতায় নতুনের যে কেন্দ্রাভিগ বর্হিমুখী অন্বেষণ সেই অন্বেষণও স্বদেশের শ্রুতি প্রতিশ্রুতিতে ফিরে ফিরে এসেছে সর্বনামের বদলে এক অসমীকৃত ‘স্ব’ দেশের খোঁজে।

___________________________________________________________________________________






        পরের পৃষ্ঠায় যাওয়ার জন্য ওপরে অনুবাদ কবিতা / ভিসুয়াল পোয়েট্রি মেনুতে ক্লিক করুন

           

                       This Web Site is best viewed with Mozilla Firefox and Internet Explorer